মুনীরুল ইসলাম::
ইসলাম বিশ্বমানবতার শান্তি ও সম্প্র্রীতির ধর্ম। ইসলাম চায় সব ধর্মের মানুষদের সঙ্গে সহাবস্থান করে চলতে। ইসলামের নবি হজরত মুহম্মদ (স) তার নবুওয়াতি জীবনে অমুসলিমদের সঙ্গে সহাবস্থানের যে বাস্তব নমুনা রেখে গেছেন, যে উদারতা সহিষ্ণুতা ও মানবতা প্রদর্শন করে গেছেন, পৃথিবীর আর কোনো ধর্ম বা মতাদর্শ তা করতে পারেনি। তিনি ছিলেন রাহমাতুল্লিল আলামিন তথা সৃষ্টিকুলের করুণার আধার।
আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে তার হাবিবের শানে ইরশাদ করেন— ‘নিঃসন্দেহে আপনি উত্তম চরিত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত আছেন।’ (সুরা ক্বালাম, আয়াত-৪) মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে পৃথিবীর বিখ্যাত মনীষীরাও মহানবি (স)-এর মহান চরিত্রের প্রশংসা করেছেন। ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ করানোর ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসুল এবং সাহাবায়ে কেরাম কোনো রকম জোর-জবরদস্তি করেননি। ইসলামের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই তখন অমুসলিমরা দলে দলে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিল।
ইসলামের নির্দেশনা হলো—যুদ্ধাবস্থায়ও অমুসলিমদের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করা যাবে না। একজন মুসলমান রাষ্ট্রীয়ভাবে যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে তা অমুসলিমও পাবে। বিশ্বাস ও আদর্শের কারণে তাকে আঘাত করা যাবে না। অমুসলিমদের সঙ্গে লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, তাদের কাছে জিনিসপত্র ভাড়া দেওয়া বা তাদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া এসব ক্ষেত্রে ইসলামে কোনো বিধিনিষেধ নেই। রাসুলুল্লাহ (স) কাফের-মুশরিকদের থেকে জিনিসপত্র কিনেছেন। আল্লাহর রাসুলের ইন্তেকালের সময়েও তার একটি বর্ম একজন ইহুদির কাছে বন্ধক ছিল। ইহুদির কাছে বর্মটি বন্ধক রেখে তিনি তার পরিবারের জন্য খাবার জোগাড় করেছিলেন।
মুসলিম ব্যক্তি অমুসলিমের কাছে দ্বীনি বিষয়াদি ছাড়া চিকিত্সা, শিল্প, কৃষি প্রভৃতি বৈজ্ঞানিক বিষয়াদিতে সহযোগিতা নিতে পারবেন ইসলাম সে অনুমতি দিয়েছে। তবে এসব ক্ষেত্রে মুসলমানদের স্বনির্ভরতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন অত্যন্ত জরুরি। রাসুলুল্লাহ (স) নিজে বিভিন্ন সময় অমুসলিমের কাছ থেকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করিয়েছেন। নবিজি মক্কা থেকে যখন মদিনায় হিজরত করে যান তখন পথ দেখাবার উদ্দেশে তিনি মক্কার মুশরিক আবদুল্লাহ ইবনে আরিকতের সাহায্য নিয়েছিলেন। মুসলিম-অমুসলিমের মধ্যে উপহার-বিনিময়ও হতে পারে। আল্লাহর রাসুল (স) অমুসলিম রাজা-বাদশাহর দেওয়া উপহার গ্রহণ করেছেন।
মদিনায় হিজরতের পর রাসুলুল্লাহ (স) মদিনাকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন। তখন মদিনা ছিল পৌত্তলিক, ইহুদি, মুসলিম—এই তিন সম্প্র্রদায়ের লোকের একটি আবাসভূমি। আল্লাহর রাসুল দেখলেন, এই সম্প্র্রদায়গুলোর মধ্যে সম্প্র্রীতি স্থাপিত না হলে মদিনার শান্তি-নিরাপত্তা, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা সম্ভব হবে না। তাই তিনি মদিনাবাসীকে একটি লিখিত শান্তিসনদ দান করেন। সনদে প্রত্যেক সম্প্র্রদায়ের নেতারা স্বাক্ষর করেন। ইতিহাসে এই সনদকে বলা হয় ‘মদিনা সনদ’। মদিনা সনদই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত রাষ্ট্রীয় মূলনীতি। এই সনদই সাক্ষ্য বহন করে যে, ইসলাম কারো সঙ্গে বিরোধ চায় না; শান্তি চায়, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে শত্রুতা চায় না; মৈত্রী চায়, কঠোরতা চায় না; উদারতা চায়। রাষ্ট্রীয় জীবনে সাম্প্র্রদায়িক সম্প্র্রীতি প্রতিষ্ঠায় ইসলামই দুনিয়ার বুকে সর্বপ্রথম বাস্তব আদর্শ স্থাপন করেছে, মদিনা সনদই তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
আমরা রাসুলুল্লাহ (স)-এর জীবনের কিছু ঘটনা থেকেও সম্প্রীতির শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। যেই অমুসলিম বৃদ্ধা আল্লাহর রাসুলকে কষ্ট দেওয়ার জন্য প্রতিদিন তার চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখত, এক দিন পথে কাঁটা না দেখে নবিজি বৃদ্ধার অসুস্থতার আশঙ্কার কথা ভেবে তার বাড়িতে ছুটে যান এবং তার খোঁজখবর নেন। আল্লাহর রাসুলের ঘরে এক ইহুদি মেহমান হয়েছিলেন। অসুস্থতার কারণে রাতে মলমূত্র ত্যাগ করে তিনি চলে যান। সকাল বেলা নবিজি নিজেই সেগুলো পরিষ্কার করেন, এরপর উদ্বিগ্ন হয়ে তার বাড়িতে ছুটে যান এবং এই বলে তার কাছে ক্ষমা চান যে, রাতে তোমার খোঁজখবর নিতে পারিনি, এজন্য হয়তো তুমি কষ্ট পেয়েছো। এভাবে আমরা মহানবি (স)-এর মহানুভবতার অসংখ্য দৃষ্টান্ত দেখতে পাই।
মসজিদে নববিতে এক বেদুইনকে পস্রাব করতে দেখে সাহাবায়ে কেরাম তাকে বাধা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহর হাবিব বললেন—না, তাকে এখন বাধা দিয়ো না, এতে তার ক্ষতি হতে পারে। এরপর বেদুইনের পস্রাব করা শেষ হলে আল্লাহর রাসুল তাকে বুঝিয়ে বললেন—দেখো, এটা আমাদের ইবাদতখানা, পবিত্রস্থান, এখানে মলমূত্র ত্যাগ করা যায় না। এরপর সাহাবিদের নিয়ে নবিজি নিজেই তা পরিষ্কার করলেন।
মক্কার বিশিষ্ট দলপতিদের নিয়ে খানায়ে কাবায় নবিজির হাজারে আসওয়াদ স্থাপন, হুদায়বিয়ার সন্ধি এবং মক্কা বিজয়ের পর কুরাইশদের সঙ্গে নবিজি যে সম্প্রীতি দেখিয়েছিলেন তা ইতিহাসে অনন্য নজির হয়ে আছে। সর্বাবস্থায় আল্লাহ আমাদেরকে সৌহার্দ-সম্প্রীতি বজায় রেখে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন!
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম
পাঠকের মতামত